ফারজানা হক : ১৯৭১ সালে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার একটি মহকুমা ছিল ঠাকুরগাঁও (বর্তমানে জেলা)। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁও বাসীর অংশ গ্রহণ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বিভিন্ন কৃষক আন্দোলন থেকে শুরু করে জাতীয় আন্দোলনে এ জেলার মানুষ তাদের অধিকার আদায়ের জন্য সবসময়ই ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় তারা মুক্তিযুদ্ধে পিছপা হয়নি এবং প্রতিরোধ ও যুদ্ধ করে।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক গণহত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম গণহত্যা ও নির্যাতন। সারা দেশের ন্যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতন ও গণহত্যা থেকে রক্ষা পায়নি ঠাকুরগাঁও জেলার মানুষেরা। তৎকালীন ঠাকুরগাঁও ছিল একমাত্র মহকুমা যা পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা দখল হয়েছে সবার পরে এবং মুক্ত হয়েছে সবার আগে। প্রায় ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ হলেও ঠাকুরগাঁওবাসী সাড়ে সাত মাস অর্থাৎ ২৩২ দিনের মাথায় স্বাধীনতা অর্জন করে এবং বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীন মহকুমার ঐতিহাসিক গৌরব নিয়ে মুক্ত দেশের পতাকা উত্তোলন করে।
২০/২১ দিন মুক্ত থাকার পর ১৫ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঠাকুরগাঁও শহরে প্রবেশ করে। পাকিস্তানি সৈন্যরা সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ভূষিরবন্দর দিয়ে দশমাইল হয়ে ভাতগাঁও ব্রিজ অতিক্রম করে ঠাকুরগাঁও শহরে প্রবেশ করে। শুরু করে নির্বিচারে গণহত্যা ও নির্যাতন। ১৭ এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যরা ঠাকুরগাঁও শহর ছেড়ে নিকটস্থ থানা সদর গুলোর দিকে অগ্রসর হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ঠাকুরগাঁও ছিল ৬ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভূক্ত। এ সেক্টরে প্রায় ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা পরিকল্পিতভাবে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করেন সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে। নভেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক অভিযান চালায়। ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে যায়। ভারতীয় মিত্রবাহিনী যাতে ঠাকুরগাঁও দখল করতে না পারে সেজন্য পাকিস্তানি সৈন্যরা ৩০ নভেম্বর ভুল্লি ব্রিজ উড়িয়ে দেয়। মিত্রবাহিনী ভুল্লি ব্রিজ সংস্কার করে ট্যাংক পারাপারের ব্যবস্থা করেন। ১ ডিসেম্বর ভুল্লি ব্রিজ পার হলেও যত্রতত্র মাইন থাকার কারণে মিত্রবাহিনী ঠাকুরগাঁও শহর ঢুকতে পারেনি। এরপর মাইন অপসারণ করে মিত্রবাহিনী ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে অগ্রসর হয়। সেসময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পুঁতে রাখা ২টি মাইন বিস্ফোরণে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর ২টি ট্যাংক ধ্বংস হয়ে যায়। ডিসেম্বর মাসের ১ তারিখে বোদা থানা শত্রুমুক্ত হয় এবং সম্মিলিত বাহিনী বীরবিক্রমে ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
ডিসেম্বর মাসের ২ তারিখ সন্ধ্যার আগেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঠাকুরগাঁও শহর থেকে তাদের শত্রু ডিফেন্স ও রিয়ার হেড কোয়ার্টার ই.পি.আর ক্যাম্পের ঘাঁটি ছেড়ে বীরগঞ্জের দিকে পিছু হটতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা ২ ডিসেম্বর রাতেই ঠাকুরগাঁও শহরে প্রবেশ করে। অবশেষে ৩ ডিসেম্বর ভোর রাতে ঠাকুরগাঁও শহর শত্রুমুক্ত হয়। এই বিজয় ছিনিয়ে আনতে ১০ হাজার মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল প্রায় দুই হাজার মা বোনকে।
৩ তারিখ সকালে সম্মিলিত বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরাট একটি দল ঠাকুরগাঁও শহরে প্রবেশ করে বিজয়োল্লাস করতে থাকে। সকালে ঠাকুরগাঁও চৌরাস্তায় বিজয় পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হয়। শহরের বিভিন্ন জায়গায় বের করা হয় আনন্দ মিছিল। জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে এ অঞ্চলের জনপদ। বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীন মহকুমা হিসেবে ঐতিহাসিক গৌরব অর্জন করে ঠাকুরগাঁও।
লেখক-ফারজানা হক, পিএইচডি গবেষক, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়।