
নবীন হাসান :- মাঘের হাড়কাঁপানো শীতের রাতে ভাপা, চিতই কিংবা পাটিসাপটার মতো পিঠার কথা মনে এলেই যেন বাঙালির মন উৎফুল্লে ভরে ওঠে। এই হারিয়ে যেতে বসা ঐতিহ্যবাহী পিঠা-পুলিকে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত করতে এবং পুরনো দিনের স্মৃতি ফিরিয়ে আনতেই ঠাকুরগাঁওয়ের কাজীপাড়ায় অনুষ্ঠিত হলো জমজমাট পিঠা উৎসব।
গত শুক্রবার আয়োজিত এ উৎসবে ৩০ জন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তাদের নিজস্ব সৃজনশীলতায় তৈরি পিঠার পসরা নিয়ে হাজির হন। চিতই, ভাপা, পাটিসাপটা, নকশী পিঠা, বিবিয়ানা, মালপোয়া, আর নানা বাহারি পিঠার সম্ভার দেখে দর্শনার্থীরা মুগ্ধ হয়ে ওঠেন। উৎসবটি বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে এবং তীব্র শীত উপেক্ষা করেও মানুষ উৎসবস্থলে ভিড় জমায়।
উৎসবের মূল আকর্ষণ ছিল উদ্যোক্তাদের পরিশ্রম ও সৃজনশীলতা। ঠাকুরগাঁওয়ের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা এখানে এসে তাদের পছন্দের পিঠার স্বাদ নেন এবং নতুন ধরনের পিঠার সঙ্গে পরিচিত হন।
কাজীপাড়ার বাসিন্দা রিনা আক্তার বলেন, শীতকাল এলেই পিঠার কথা মনে পড়ে। এই উৎসব আমাদের হারানো ঐতিহ্যকে মনে করিয়ে দিল। পরিবারের সবাই মিলে এখানে এসে খুব আনন্দ পেয়েছি।
এদিকে, তরুণ প্রজন্মের অনেকেই এ ধরনের আয়োজন দেখে মুগ্ধ। কলেজছাত্রী সামিয়া সুলতানা জানান, আগে দাদির কাছে পিঠার গল্প শুনেছি, কিন্তু এত রকম পিঠা দেখার অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি। এখানে এসে প্রথমবারের মতো নকশী পিঠা খেয়েছি। খুব ভালো লেগেছে।
উৎসবে অংশ নেওয়া উদ্যোক্তারা জানান, তাদের জন্য এ ধরনের আয়োজন শুধুমাত্র ব্যবসার সুযোগ নয়, বরং সৃজনশীলতা প্রদর্শনের মঞ্চ। সাদিয়া পারভীন, যিনি বিভিন্ন ধরণের ভাপা পিঠা নিয়ে এসেছিলেন।তিনি বলেন, আমার তৈরি পিঠা যখন মানুষ পছন্দ করে, তখন মনে হয় পরিশ্রম সার্থক। এমন আয়োজন বারবার হলে আমরা আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারি।
অন্যদিকে, মিষ্টি পাটিসাপটা সহ ঝালপিঠা নিয়ে আসা উদ্যোক্তা শাহনাজ বেগম বলেন, “এখানে এসে দেখি অনেক মানুষ আমাদের পিঠা কিনছেন। এরকম উৎসব আমাদের কাজে উৎসাহ জোগায়। নতুন নতুন পিঠার আইডিয়া নিয়ে কাজ করার অনুপ্রেরণা পাই।”
আমাদের উদ্দেশ্য ছিল হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করা। পিঠা শুধু খাবার নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতির অংশ। নতুন প্রজন্মকে এটি জানানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
এছাড়াও এ উৎসবের মাধ্যমে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা যেমন তাদের কাজের স্বীকৃতি পান, তেমনি দর্শনার্থীরা একদিনের জন্য হলেও গ্রামীণ ঐতিহ্যের ছোঁয়া অনুভব করতে পারেন। ভবিষ্যতে এ ধরনের আয়োজন নিয়মিত করার পরিকল্পনা আছে বলে জানান পিঠা উৎসবের আয়োজকরা।
উৎসব দেখতে ঠাকুরগাঁও ও আশপাশের এলাকা থেকে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ ভিড় জমায়। পুরো পরিবেশে ছিল এক আনন্দঘন আবহ। ভাপা পিঠার ধোঁয়া আর নকশী পিঠার সৌন্দর্য যেন ঐতিহ্যের এক মধুর গল্প শোনাচ্ছিল।
দর্শনার্থী মনিরুল ইসলাম বলেন, “অনেক দিন পর এমন একটি উৎসব উপভোগ করলাম। পরিবারের সবাইকে নিয়ে এসেছি। খুব ভালো সময় কাটালাম।”
উৎসবের শেষ পর্যায়ে দর্শনার্থীদের একটি সাধারণ অনুরোধ শোনা গেল—“এমন আয়োজন যেন আরও বড় আকারে করা হয় এবং নিয়মিত হয়।”
তীব্র শীত উপেক্ষা করেও রাত বারোটা পর্যন্ত চলা এই পিঠা উৎসব নতুন করে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যে। ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষদের জন্য এটি ছিল শীতকালীন উৎসবের এক ব্যতিক্রমী উদযাপন।