Home » ঠাকুরগাঁওয়ের লিগ্যাল এইড: দরিদ্র মানুষের ন্যায় বিচারের নতুন ঠিকানা

ঠাকুরগাঁওয়ের লিগ্যাল এইড: দরিদ্র মানুষের ন্যায় বিচারের নতুন ঠিকানা

by নিউজ ডেস্ক

জাহিদ হাসান মিলু : ন্যায়বিচার সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে—এই ধারণা এখন অতীত। ঠাকুরগাঁওয়ে সরকারি লিগ্যাল এইড কার্যক্রম দরিদ্র, অসহায় ও প্রান্তিক মানুষের জন্য ন্যায়ের দরজা উন্মুক্ত করেছে নতুনভাবে। মামলা-মোকদ্দমার দীর্ঘসূত্রতা, বিশাল খরচ ও আইনি জটিলতা কাটিয়ে দ্রুত ও মানবিক সমাধানের একটি কার্যকর প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে জেলা লিগ্যাল এইড অফিস।

১৯৯৭ সালে সেবা যাত্রা শুরুর পর ধীরে ধীরে বিস্তৃত হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিষ্ঠানটি আরও গতিশীল হয়েছে। বর্তমানে লিগ্যাল এইড অফিসার (সিনিয়র সহকারী জজ) মো. মজনু মিয়া দায়িত্ব নেওয়ার পর অভিযোগ গ্রহণ, যাচাই, মধ্যস্থতা ও নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে স্পষ্ট উন্নতি এসেছে। সেবার পরিধি যেমন বেড়েছে, তেমনি মানুষের আস্থাও দৃশ্যমানভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

এক বছরে সেবা গ্রহণকারীর সংখ্যা রেকর্ড—৫২২ জন :

জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে অক্টোবর ২০২৫ পর্যন্ত—বিনা খরচে আইনি সহায়তা পেয়েছেন ৫২২ জন। মোট অভিযোগ গ্রহণ হয়েছে ৫৭৮। মধ্যস্থতায় নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৪০ । সরকারি খরচে মামলা দায়ের হয়েছে ১১১। আর ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ আদায় হয়েছে প্রায় ৫৪ লাখ টাকা। এই কার্যক্রমে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে মামলা ছাড়াই বিরোধ নিষ্পত্তি। ফলে আদালতের মামলার জট কমছে, ভুক্তভোগীরা দ্রুত সমাধান পাচ্ছেন।
ঠাকুরগাঁওয়ের ৫টি উপজেলাতেই লিগ্যাল এইড কমিটি সক্রিয় করা হয়েছে। পাশাপাশি ৫৪টি ইউনিয়নে উপকমিটি গঠনের ফলে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে সরকারের আইনি সেবা। স্কুল–কলেজ, মসজিদ–মন্দির, ইউনিয়ন পরিষদ, বাজার থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক সমাবেশে সচেতনতামূলক সভা, লিফলেট বিতরণ এবং সেমিনার অনুষ্ঠিত হচ্ছে নিয়মিত। ফলে যারা আগে আইনি সহায়তা নিতে ভয় পেতেন বা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, তারাও এখন নিশ্চিন্তে সেবা নিতে আসছেন।

সাম্প্রতিক একটি সেমিনারে উপস্থাপিত হয় অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী একটি ঘটনা:
৩৫ বছরের দাম্পত্য জীবনে ভুল বোঝাবুঝি ও পারিবারিক বিরোধের কারণে এক দম্পতির সন্তানরা মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে চলা এই সম্পর্কের জট খুলতে কেউ সফল হননি। পরে অভিযোগ করা হলে লিগ্যাল এইড অফিস উভয় পক্ষকে ডেকে মধ্যস্থতা করে। কোনো খরচ ছাড়াই মা আবার ফিরে পান সন্তানদের। এই ঘটনার বর্ণনায় সেমিনারে উপস্থিত সবাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।

জমি-বিরোধ নিষ্পত্তিতে কার্যকর ভূমিকা:
জমি–জায়গা নিয়ে ঝামেলা ঠাকুরগাঁওসহ উত্তরাঞ্চলের মানুষের জন্য দীর্ঘদিনের সমস্যা। লিগ্যাল এইড অফিস মাঠপর্যায়ে নেমে পরিমাপ, নথি যাচাই, সীমানা নির্ধারণ করে এসব বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তেমনি এক ভুক্তভোগী জমির মালিক পারুল বেগম বলেন, বছরের পর বছর জমি নিয়ে আমাদের ঝামেলা চলছিল। লিগ্যাল এইড অফিস সব কথা শুনে সঠিক বাটোয়ারা নির্ধারণ করল। মনে হলো বোঝা নেমে গেল। আমরা ন্যায্যটুকুই পেয়েছি।

আরেক মালিক ইমদাদুল হক বলেন, নিজেদের চেষ্টায় বারবার সমস্যা তৈরি হত। শেষে লিগ্যাল এইড মাঠে গিয়ে নথি দেখে সীমানা ঠিক করে দেয়। এখন কোনো বিরোধ নেই। এ ধরনের সমাধান শুধু পরিবার বা দুই পক্ষকে নয়, পুরো সমাজকেই বিরোধ ও উত্তেজনা থেকে মুক্ত করে।

ঠাকুরগাঁও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘লিগ্যাল এইড দরিদ্র মানুষকে আইনের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে। শুধু মামলা নয়, সমঝোতা–মধ্যস্থতার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধান সমাজে স্থিতিশীলতা বাড়াচ্ছে।’

জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার মো. মজনু মিয়া বলেন, ‘সাধারণ মানুষ যাতে আর্থিক কারণে আইন থেকে বঞ্চিত না হয়, সেটাই আমাদের মূল লক্ষ্য। আমরা সরকারি খরচে মামলা পরিচালনা থেকে শুরু করে মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি—সব ধরনের সহায়তা দিই।’ তিনি আরও বলেন—‘জমি-বিরোধ, পারিবারিক বিরোধ, দেনমোহর, ভরণপোষণ, এমনকি আপসযোগ্য ফৌজদারি মামলারও সমাধান দেয়া হয়। সরেজমিনে গিয়ে নথি যাচাই ও উভয় পক্ষকে নিয়ে বসার মাধ্যমে আইনের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ছে।’

এখন ঠাকুরগাঁওয়ের সাধারণ মানুষ জানেন, আইনি সহায়তা মানেই জটিলতা নয়। সত্যিকারের দরজায় কড়া নড়লেই সঠিক সমাধান পাওয়া যায়। সরকারি লিগ্যাল এইড সেবা প্রমাণ করেছে—ন্যায়বিচার সবার জন্য, এবং বিচার পাওয়ার অধিকার অর্থবিত্তের ওপর নির্ভর করে না বলে মন্তব্য করেন অনেকে।

You may also like